বাংলা সাহিত্যে আমরা যা পড়ি তা গল্প নাকি উপন্যাস তা কিভাবে বুঝবো? গল্প হক বা উপন্যাস প্রত্যেকটির কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী থাকে যা জানা থাকলে আমরা সহজে গল্প আর উপন্যাসের মধ্যে পার্থক্য খুজে পাবো। গল্প এবং উপন্যাস দুইটার পাঠকও আলাদা হয়ে থাকে। অনেকে ছোট গল্প পছন্দ করে, তো আবার অনেকে ছোট উপন্যাস পছন্দ করে। তেমনি ভাবে অনেকে বড় গল্প পছন্দ করে আবার অনেকে বড় উপন্যাস। আমাদের সকলের পছন্দ, আবেগ, অনুভতি সব কিছু আলাদা ধরনের হয়ে থাকে, আবার কিছু ক্ষেত্রে মিলেও যেতে পারে। তো আজকে আমি আপনাদের সাথে গল্প এবং উপন্যাসের মধ্যে কিছু ছোট পার্থক্য এবং বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।
গল্প কাকে বলে ও কত প্রকার?
গল্প বলতে সাধারণত কোন একটি বা একাধিক ঘটনার সমন্বিত বর্ণনাকে বুঝানো হয়। গল্প বাংলা গদ্য সাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ ও সর্বকনিষ্ঠ শাখা। গল্প অনেক ছোট আকারের হতে পারে, আবার অনেক বড় কয়েকটি প্রেক্ষাপট নিয়েও হতে পারে। একজন লেখক গল্পে পরিকল্পিত ভাবে একটা ঘটনা বা প্লট ফুতে তোলার চেষ্টা করে। যেমন বাংলা নাটকে একটা গটনাকে কেন্দ্র করে সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়ে থাকে। গল্প লেখা অনেকটা সহজ কারণ গল্প একটা ছোট ঘটনা বা কাহিনিকে কেন্দ্র করে সল্প পরিসরে লেখা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে গল্প দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকেঃ
ছোট গল্পঃ ছোট গল্পের একটি প্লট থাকে যা খুব সল্প আকারে বর্ননা করে শেষ করা হয়ে থাকে। এখানে অনেক ছোট গল্পের ক্ষেত্রে কাহিনি শেষ হয়েও যেন শেষ হয় না এমন ভাবে লেখা হয়ে থাকে। এখানে গল্পের একটি মাত্র প্লট বা স্থান থাকে যা ঐ কেন্দ্রিক লেখা হয়ে থাকে। এমন গল্পে খুব অল্প কিছু চরিত্র থাকে যা দিয়ে সম্পুর্ন গল্প খুব ভালো ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়ে থাকে।
বড় গল্পঃ বড় গল্পের ক্ষেত্রে গল্পের স্থান বা কাহিনি এক বা একাধিক হতে পারে। এখানে লেখক ঘটনাকে একটি সম্পুর্ন রুপ দিতে সক্ষম হয়ে থাকে এবং গল্পের কাহিনি শেষ পরিনতি হয়ে থাকে। এটি ছোট গল্পের চেয়ে একটি বেশি দির্ঘ হয়ে থাকে।
উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য সমূহ
আমরা অনেকে উপন্যাস পড়তে চাই বা উপন্যাস পড়তে ভালবাসি। কিন্তু আমরা কি উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সঠিক ভাবে যানি? আমরা যদি উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতাম তা হলে উপন্যাস পড়ার আনন্দ আমাদের মাঝে আরও বেশি উপলব্ধি করতে পারতাম। একজন লেখক তার কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে একটি বৃহদাকার উপন্যাস লিখে থাকেন। উপন্যাস লেখার নির্দিষ্ট বাদাধরা নিয়ম নেই। কিন্তু উপন্যাসের ভিতর দিয়ে মানব-মানবীয় জীবনযাপনের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়ে থাকে। উপন্যাসের ঘটনাকে এমন ভাবে সাজানো হয় যেন বাস্তব জীবনকে প্রতিফলিত করে এবং কাহিনিকে আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক ও বাস্তবোচিত করে তোলে।
উপন্যাসের কিচছু গঠন কৌশল রয়েছেঃ
- প্লট বা আখ্যান
- চরিত্র
- সংলাপ
- পরিবেশ বর্ণনা
- শৈলী বা স্টাইল
- লেখকের সামগ্রিক জীবন-দর্শন
উপন্যাসের শ্রেণী বিন্যাস
উপন্যাস বিভিন্ন সময় তার গঠন কৌশল ও বিষয়, চরিত্রের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন শ্রেণীর হয়ে থাকে। উপন্যাস বিভিন্ন সময় কখনও কাহিনি নির্ভর, কখনও চরিত্র নির্ভর, কখনও মনস্তাত্ত্বিক, কখনও বক্তব্যধর্মী হয়ে থাকে।
সামাজিক উপন্যাস
উপন্যাস বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত তাযার মধ্যে একটি হচ্ছে সামাজিক উপন্যাস। এই শ্রেণীর উপন্যাসের সুচনা ঘটে প্রায় উনিশ শতকের দিকে। সেই সময় ইংরেজি উপন্যাসগুলোতে সেকালের সমাজের নানা অন্যায়-অবিচার, কুপ্রথা প্রভৃতির উদ্ঘাটন এবং সেসব কাজের সমালোচনার মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এভাবেই সামাজিক উপন্যাসের সৃষ্টি হয়ে আসে এবং ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান যুগের মহিলা ঔপন্যাসিক এলিজাবেথ ক্লেগহর্ন গ্যাসকেল সমাজ সংস্কারের আদর্শ নিয়ে উপন্যাস রচনার ব্রতী হয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক উপন্যাস
গুরুত্বপূর্ণ কোন ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্রকে কেন্দ্র করে যে উপন্যাস রচিত হয় তাকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখন নতুন কোন ঘটনা বা চরিত্র সৃজন করে কাহিনিকে গতিময় ও প্রাণসঞ্চার করে থাকে কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য কে বিচ্যুত করতে পারে না।
মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস
মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের প্রধান আশ্রয় পাত্র-পাত্রীর মনোজগতের ঘাত-সংঘাত ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া; চরিত্রের অন্তর্জগতের জটিল রহস্য উদ্ঘাটনই ঔপন্যাসিকের প্রধান লক্ষ্য। সামাজিক উপন্যাস এবং মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের কিছু মিল খুজে পাওয়া যায়। মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসে কাহিনি অবলম্বন মাত্র, প্রকৃত উদ্দেশ্য থাকে মানবমনের জটিল দিকগুলো সার্থক বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা।
রাজনৈতিক উপন্যাস
একটি দেশের বা সমাজের রাজনৈতিক ঘটনাবলী, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং রাজনিতির সাথে জরিত চরিত্রের কর্মকাণ্ড যে উপন্যাসে লক্ষ করা যায় তাকে রাজনৈতিক উপন্যাস বলে। এ ধরনের উপন্যাসে রাজনৈতিক ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আন্দোলন-সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিপুল পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে আসে।
কাব্যধর্মী উপন্যাস
এ ধরনের উপন্যাসে একজন লেকখকের জীবনদর্শন ও গীতিধর্মিতা প্রকাশ পায়। এখানে রবিন্দ্রনাথের শেষের কবিতা এ জাতীয় একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
গোয়েন্দা উপন্যাস
অপরাধ ও গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়ে যে সকল উপন্যাস রচিত হয় তাকে গোয়েন্দা উপন্যাস বলা হয়ে থাকে। গোয়েন্দা উপন্যাসের মধ্যে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের দারোগার দপ্তর, বনফুলের পঞ্চপর্ব, শরচ্চন্দ্র সরকারের গোয়েন্দাকাহিনী উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তবে বাংলা গোয়েন্দা উপন্যাসের সবচেয়ে চেনা উদাহরণ সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা গোয়েন্দা সিরিজ। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যে অনেক লেখকের গোয়েন্দা উপন্যাস উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
পত্রোপন্যাস উপন্যাস
যে সকল উপন্যাস বক্তব্য পত্রের আকারে প্রকাশ করা হয় তাদের কে পত্রোপন্যাস বলা হয়। যেমন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ক্রৌঞ্চমিথুন, বুদ্ধদেব গুহর সবিনয় নিবেদন ইত্যাদি।
হাস্যরসাত্মক উপন্যাস
হাস্যরসাত্মক উপন্যাসে লেখক মানবজীবনের যে-কোনো একটি অসঙ্গতিকে বিষয় বস্তু করে হাস্যরসাত্মক চরিত্র সৃষ্টি করেন। যেমন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুক্তির উপায়’ , প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রসময়ীর রসিকতা’, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘ওরা ও আমরা’ ইত্যাদি হাস্যরসাত্মক উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত।
আত্মজৈবনিক উপন্যাস
আত্মজৈবনিক উপন্যাসে লেখক তার নিজের জীবনের বিভিন্ন সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতকে যখন একটি লেখনিতে শিল্পকুশলতায় উপন্যাসে রূপান্তরিত করে তখন তাকে আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলে। এ ধরনের উপন্যাসে লেখকের ব্যক্তি জীবনের অনেক ঘটনা কল্পনাতে রূপান্তরিত হয়ে একটি অন্তর্ময় বৈশিষ্টমণ্ডিত ঘটনাসূত্র প্রকাশ করে।
আঞ্চলিক উপন্যাস
কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না মিশ্রিত যে কাহিনী বা উপন্যাস তাই আঞ্চলিক উপন্যাস বলে। কোন অঞ্চল বিশেষের মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রার পরিবেশ নিয়ে যে উপন্যাস লেখা হয় তাকে আঞ্চলিক উপন্যাস বলা হয়। এখানে মানুষের জীবনের সাথে জরিত সামাজিক বস্তু-বিষয়, গ্রাম্য পরিবেশ, নদী-নালা অনেক কচছু একত্রে থাকতে পারে।
রহস্য উপন্যাস
রহস্য উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের প্রধান লক্ষ্য রহস্যময়তা সৃষ্টি করা এবং উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখা। এ ধরনের উপন্যাসে একজন পাঠক রহস্য উদঘাটনের জন্য রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার মাধ্যমে গল্প শেষ করে। দীনেন্দ্রকুমার রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, কাজী আনোয়ার হোসেন প্রমুখ লেখক বাংলা ভাষায় বহু রহস্যোপন্যাস লিখেছেন।
রূপক উপন্যাস
রূপকাশ্রয় সাহিত্যের কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। অনেক সময় উপন্যাসিক তার রচনায় উপস্থাপিত কাহিনি কাঠামোর অন্তরালে কোনো বিশেষ ব্যতিক্রমধর্মী রূপকাশ্রয়ী বক্তব্যের সাহায্যে উপন্যাসের শিল্পরূপ প্রদান করেন যে উপন্যাসকে রূপক উপন্যাস বলা হয়। রূপক উপন্যাসে লেকখকের কাল্পকিন জগতের প্রতিফলন প্রকাশ পায়। প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েলের রুপক উপন্যাস ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ উপন্যাসে যেখানে পাত্রপাত্রী মানুষ নয় জন্তু-জানোয়ার রুপে প্রকাশ পায়। এভাবেই লেখন তার কল্পনাকে এক বাস্তব রূপক উপন্যাস হিসেবে জীবন দিয়ে থাকেন।
চেতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস
মানুষের মনের মধ্যে বর্তমান সময়ের অভিজ্ঞতা, অতীতের স্মৃতি এবং ভবিষ্যতের কল্পনা প্রবাহিত হতে থাকে। এই প্রবাহের উপর বর্ণনা করে চেতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস লিখিত হয়। আইরিশ লেখক জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ এমনই একটি বিখ্যাত চেতনাপ্রবাহ রীতির উপর লিখিত উপন্যাস।
রোমান্সধর্মী উপন্যাস
রোমান্স বলতে বোঝায় বীরত্বপূর্ণ এক ধরনের অবাস্তব কাল্পনিক উচ্ছ্বাসপূর্ণ ভাষাযুক্ত কাহিনী । ইউরোপীয় রোমান্সের আদি জননী দা অ্যারাবিয়ান নাইটস । তবে বর্তমানে রোমান্স বলতে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কল্পনাময় মানবিক কাহিনীকে বুঝানো হয়। এর ফলে কল্পনাভাসারী মন এবং অতীতপ্রীতির কথা উঠে আছে।
পুরাণ কাহিনীমূলক উপন্যাস
পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে এ ধরনের উপন্যাস রচিত হয় যার কাহিনী কাল্পনীক এবং অবাস্তব সম্পুন্ন হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে দীনেশ সেনের শ্যামল ও কজ্জল, জড়ভরত ও বেহুলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পুরাণ কাহিনীমূলক উপন্যাস।
বীরত্বব্যঞ্জক উপন্যাস
বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী অবলম্বনে এ ধরনের উপন্যাস রচিত হয়। মণীন্দ্রলাল বসুর অজয়কুমার এ শ্রেণিভুক্ত উপন্যাস।
শেষকথাঃ
এতক্ষণ আমরা গল্প ও উপন্যাস কাকে বলে এবং উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য সমূহ নিয়ে কিছু আলোচনা করলাম। আবার উপন্যাস যে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত তা সম্পর্কেও কিছু ধারণা পেলাম। আমরা অনেকে উপন্যাস পড়তে ভালোবাসি কিন্তু উপন্যাস সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকার কারণে কখন কোন শ্রেণীর উপন্যাস পড়ছি তা জানি না। এসব কারণে দেখা যায় উপন্যাসের আসল মজা অনেকাংশে আমরা খুজেই পাই না। তাই আমাদের উপন্যাস পড়ার আগে কোন শ্রেণীর উপন্যাস পড়তেছি সে সম্পর্কে ভাল ভাবে আগে জানতে হবে এবং তারপর পড়তে হবে।