বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হচ্ছে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম জন্মলাভ করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ভাষা আন্দোলন বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের থেকে শুরু হয়ে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক ও মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার প্রথম সংগ্রাম।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলো ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। পূর্ব বাংলা হয় পাকিস্তানের অংশ-পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব থেকে জনগণ আশা করেছিলেন, এবার তাঁদের আশা- আকাঙ্খা পূরণ হবে। তাঁদের প্রত্যাশিত স্বাধীনতা নতুন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হবে। উন্নত জীবনের অধিকারী হবেন। কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অনুভব করলেন, তাদের প্রত্যাশা পূর্ণ হওয়ার নয়। পাকিস্তানের শাসকবর্গ বহুবাচনিক সমাজে পূর্ব পরিকল্পিত ঐক্যবদ্ধ একক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র সংকুচিত করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁরা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। এমন কি পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এভাবে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা সংগ্রামরে পটভূমি তৈরি হয়। ১৯৫২ সালে নিজস্ব ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য জীবন দান করতে হয় পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র জনতার। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করে। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালীর স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ছয় দফা ম্যান্ডেট নিয়ে পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে তার উত্তরণ ঘটে। জনগণ প্রত্যাশা করেছিল নির্বাচিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ইতিহাসের গতি পাল্টাবেন। পাকিস্তানের শাসকবর্গ-কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং কিছু সামরিক কর্মকর্তা-ষড়যন্ত্রের গ্রন্থিগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত করেন যেন শাসন ক্ষমতা কোনক্রমে বাঙ্গালীর হস্তগত না হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তা সঠিকভাবে অনুধাবন করেন।
গণআন্দোলন মাধ্যমে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে সংগঠিত হয়। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালে তখন দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। একটি হচ্ছে ভারত আরেকটি হচ্ছে পাকিস্তান। রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় পাকিস্তানে। পাকিস্তানের উর্দুভাষী বুদ্ধিজীবীরা ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। অপর দিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দাবি ওঠে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষার এ দাবিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে। এতে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহল ও ছাত্র জনতা ক্ষুব্ধ হন এবং ভাষার ব্যাপারে তাঁরা একটি চূড়ান্ত দাবিনামা প্রস্তুত করেন। এবং তাদের দাবিটি হলো: পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা ও সরকারি কার্যাদি পরিচালনার মাধ্যম হবে বাংলা আর কেন্দ্রীয় সরকার পর্যায়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি বাংলা ও উর্দু। তমদ্দুন মজলিস সংগঠিত হয় ভাষাসংক্রান্ত এই দাবিকে সামনে রেখে। অধ্যাপক আবুল কাসেম এর নেতৃত্বে ছিলেন। অনেক অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল সংগঠন এই আন্দোলনে যোগ দেয় এবং একসময় তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পাকিস্তানে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার প্রচেষ্টা চলে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ ক্ষেপে যায়। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভার আয়োজন করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। সভার পরও মিছিল-প্রতিবাদ বিরতিহীন ভাবে চলতে থাকে। যার আহবায়ক ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া। এ মাসেরই শেষদিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরের বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যিনি পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেস দলের সদস্য তিনি এ প্রস্তাবে সংশোধনী এনে বাংলাকেও পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি জানান। তিনি আরও বলেন পাকিস্তানের মোট ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখই পূর্ব পাকিস্তানের, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বিরোধিতা করলে এ দাবি বাতিল হয়ে যায়। এই খবর ঢাকায় পৌঁছলে ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা খুব বিক্ষুব্ধ হন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আনা প্রস্তাবে যারা বিরোধিতা করেছিল তাদের সমালোচনা করা হয় আজাদ-এর মতো পত্রিকায়। শামসুল আলম আহবায়ক হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন পরিচালনার জন্য একটি নতুন রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠিত করেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এ আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত হয় ১৯৫২ সালে এবং সেই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছাত্ররা একত্রিত হয়। পুলিশ এ জনসমাবেশের উপর গুলি চালানোর ফলে রফিক, সালাম, বরকত, জববারসহ আরো অনেকে শহীদ হয়। এই ঘটনা আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দান করে এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। ১৯৫৬ সালে চূড়ান্তভাবে সংবিধানে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম প্রধান জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৯৫৪ সালে ১০ই মার্চ পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন বাঙালির গণতান্ত্রিক চেতনা এবং অধিকার অর্জনের আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে। বাঙালির এই আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তান শাষকগোষ্ঠী। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয় মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে ৩০শে মে। জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ বাঙালি, অতএব এই নির্বাচনের ফলাফল চিন্তা করে কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একই সময়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের কৌশলে কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যেও বিরোধ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয় ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর। সামরিক শাসন তুলে নেয়া হ’লে ছাত্র সমাজ অধিকারের দাবিতে পুনরায় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায় ১৯৬২ সালে।
শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের এবং সাধারণ জনগণের প্রতিবাদ। এই আন্দোলন নতুন করে গণ-আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। পাকিস্তান সরকার শরীফ শিক্ষা কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করে ১৯৫৯ সালে। এই কমিশনের প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত হয় যে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যয় সংকোচন করতে হবে এবং উচ্চশিক্ষায় সুযোগ সীমিত করতে হবে। এই নীতি শিক্ষার সুযোগকে ধনী ও শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়াস বলে বাঙালিরা মনে করেছিল। শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রতিবাদে ছাত্রদের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলন শুরু হয় ১৯৬২ সালে। শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশের গুলিতে ১৭ই সেপ্টেম্বর নিহত হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ নাম না-জানা অনেকেই। ছাত্র সমাজের ২২ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে ১৭ই সেপ্টেম্বর ‘৬৩ ‘শিক্ষা দিবস’ পালন উপলক্ষে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলসমূহ ও বুদ্ধিজীবী সমাজ ছাত্রদের এই আন্দোলনের সবরকম সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে সরকার শিক্ষা সংকোচন নীতি বাস্তবায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়। এই আন্দোলন ভবিষ্যতে ছয় দফা আন্দোলন এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে যুবসমাজের ভূমিকা আরও জোরদার করে।
বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা ৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন। পাকভারত যুদ্ধের সময়কালে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয় পূর্ব বাংলা সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত ছিল ১৯৬৫ সালে। স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণের ধারাবাহিকতায় পূর্ববাংলার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ন্যূনতম উন্নতি করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। বাঙালিদের প্রতি জাতিগত এই বৈষম্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী লাহোরে আহত ‘সর্বদলীয় জাতীয় সংহতি সম্মেলন’ শেখ মুজিবর রহমান ৬ দফা দাবী উপস্থাপন করেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘গত দুই যুগ ধরে পূর্ব বাংলাকে যেভাবে শোষণ করা হয়েছে তার প্রতিকারকল্পে এবং পূর্ব বাংলার ভৌগোলিক দূরত্বের কথা বিবেচনা করে আমি ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করছি। দাবি গুলো হলঃ (১) শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি (২) কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা (৩)মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা (৪) রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা (৫) বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা (৬) আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা। পরবর্তীতে এই ৬ দফা দাবি বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ হিসাবে বিবেচিত হয়।
বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনে একটি মাইলফলক হল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এটি পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষ থেকে বাঙালিদের রাজনৈতিক চেতনা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে দমনের প্রচেষ্টা। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সামরিক বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের এক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। সংগঠনের কোন এক সদস্যের অসতর্কতার ফলে পাকিস্তান সরকারের কাছে এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকার সামরিক বেসামরিক ২৮ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। ১৯শে জুন ‘৬৮ পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবর রহমানসহ ৩৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে এক রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে। এই মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত। ১৯শে জুন ১৯৬৮, ঢাকা সেনানিবাসে এই মামলার বিচার শুরু হয়। বিচার কার্য চলার সময় থেকে শ্লোগান ওঠে- ‘জেলের তালা ভাঙব- শেখ মুজিবকে আনব।’ এই গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বলা যায়, এই সময় সমস্ত দেশব্যাপী সরকার বিরোধী আন্দোলন পূর্ণতা লাভ করে।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হল ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান আন্দোলন। এটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ, যা স্বাধীনতার সংগ্রামের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক শ্লোগান পরিবর্তিত হয়। ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা। ‘জাগো জাগো-বাঙালি জাগো’। এই ধারাবাহিকতায় স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকে উন্মক্ত করে। এই সময় রাজনৈতিক দলের ৬ দফা দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। বাঙালি একক জাতিসত্তার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান দেশে সামরিক শাসন জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এই গণ-আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে ২০শে জানুয়ারী’ ৬৯ ছাত্র আসাদুজ্জামান এবং ২৪শে জানুয়ারী ৬৯ স্কুল ছাত্র মতিউর রহমান মৃত্যুবরণ করে। ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকায় শহীদ আসাদ-মতিউর দুটি উল্লেখযোগ্য নাম। শেরে বাংলা নগর ও মোহাম্মদপুরের সংযোগ স্থলের আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে ‘আসাদ গেট’ এবং বঙ্গভবনের সামনের উদ্যানের নাম ‘মতিউর রহমান শিশু উদ্যান’ করা হয়। জানুয়ারী ‘৬৯ এ গৃহিত ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ৬৯ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত অবস্থায় বন্দী আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক মৃত্যুবরণ করেন। ১৮ই ফেব্রুয়ারি ৬৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডঃ শামসুজ্জোহা পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই মৃত্যু সংবাদ গণ- আন্দোলনে আরেকটি নতুন মাত্রা যুক্ত করে। প্রচন্ড-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারি’ ৬৯ এই মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। ২২শে ফেব্রুয়ারি ৬৯, শেখ মুজিবর রহমানসহ অভিযুক্ত সকলেই ঢাকা সেনানিবাস থেকে মুক্তি লাভ করেন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির একক এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২৩শে ফেব্রুয়ারি’ ৬৯ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল গণ-সম্বর্ধনায় শেখ মুজিবর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এই মামলায় অভিযুক্ত ও বন্দী অবস্থায় সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ডঃ শামসুজ্জোহাকে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। উভয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক হিসাবে চিহ্নিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সার্জেন্ট জহুরুল হক হল’ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শামসুজ্জোহা হল’ তাদের স্মরণে নামকরণ করা হয়েছে। ‘৬৯ এর এই ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, তোফায়েল আহমেদ, আসম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, সামসুদ্দোহা, মোস্তফা জামাল হায়দর, রাশেদ খান মেনন, বেগম মতিয়া চৌধুরী, দীপা দত্ত, হায়দর আকবর খান রণোসহ অনেকে। রাজনৈতিক দলীয় প্রধান যাদের নিরলস পরিশ্রম ও নির্দেশনায় বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের এই আন্দোলন পূর্ণতা লাভ করেছিল তাদের মধ্যে জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু।
২৫শে মার্চ ৬৯ সারা দেশে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও সামরিক সরকার গণ-দাবিকে উপেক্ষা করার মত শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। তাই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সারা দেশে এক ব্যক্তি এক ভোটের নীতিতে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ৭ই ডিসেম্বর ‘৭০ থেকে ১৯শে ডিসেম্বর’ ৭০ এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে তফসিল ঘোষণা করা হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে দেশব্যাপী এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ৬ দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে রায় প্রদান করে। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ৩১০ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের ম্যান্ডেট লাভ করে। ‘বাঙালির শাসন মেনে নেওয়া যায় না’ এই নীতিতে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগণ নির্বাচিত এই জন প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিবন্ধক হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার জাতীয় নেতৃবৃন্দ এর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় অধিকারের সংঘাত। ছাত্র সমাজ এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ৭০ এ বঙ্গবন্ধু এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে পূর্ব বাংলার ম্যাপ অংকিত একটি পতাকা প্রদান করেন। এই পতাকাই পরবর্তীতে বাংলাদেশের পতাকা হিসাবে গৃহীত হয়। ছাত্রদের এই সংগঠন প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে প্রতিটি জেলা ও মহকুমা শহরে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণের মহড়া। জাতীয়তাবাদী এই আন্দোলনে ছাত্র ও যুব সমাজের অংশগ্রহণ জন সমাজকে আরো উৎসাহিত করে তোলে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এই অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে বিশিষ্ট ডিভিশনগুলো ছিল মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড ফোর্স, মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কে ফোর্স এবং মেজর কে এম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস ফোর্স। আওয়ামী লীগের ছাত্রনেতারা মুজিব বাহিনী, কাদের বাহিনী এবং হেমায়েত বাহিনী সহ মিলিশিয়া ইউনিট গঠন করে। মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিবাহিনী গঠিত হয় এবং ভারতের বিভিন্ন শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। এবং এই সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধক্ষেত্র ভাগ করে দেয়। মেজর জিয়াউর রহমানসহ অনেক সামরিক ও বেসামরিক নেতা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন, ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। আহত হওয়ার সংখ্যা শহীদের চেয়েও অনেক বেশি। লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি পুড়েছে, সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে হাজার হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কাল ছিল বাঙালির রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক চেতনার জাগরণের একটি ধারাবাহিক অধ্যায়। ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির জাতীয়তাবোধের প্রথম প্রকাশ, যা ধীরে ধীরে ছয় দফা, গণঅভ্যুত্থান, এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পথ তৈরি করে। এই দীর্ঘ সংগ্রামে বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং বাঙালির স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস আমাদের এই সংগ্রামের প্রতীক।
হুমায়ন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় নাম। হুমায়ন আহমেদের লেখা সকল বই, বইপ্রেমিদের নানা ভাবে…
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলের একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি। তার লেখা সকল কবিতা পাঠকদের নানা ভাবে…
নাটক ও উপন্যাস পছন্দ করে না এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই দেখা যায়। মানুষের বিনোদন…
বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস জগতের গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হচ্ছে আঞ্চলিক উপন্যাস। আঞ্চলিক উপন্যাসের মধ্যে কোন একটি…
রাজনৈতিক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এমন একটি শাখা যেখানে কোনো রাজনৈতিক ঘটনা, রাজনৈতিক পরিবেশ, রাজনৈতিক ব্যক্তি,…
ইসলামিক উপন্যাস মূলত মুসলিম ধর্মের জনসাধারণের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এর কারণ…