বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য প্রতিভাধর লেখক রয়েছেন যারা তাদের অনন্য রচনা ও চিন্তাধারার মাধ্যমে পাঠকদের মুগ্ধ করেছেন। তাদের রচনা শুধু বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তা নয়, বিশ্বসাহিত্যেও বিশেষ স্থান দখল করেছে। এমনই বাংলা ভাষার বিখ্যাত ১০ লেখক এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং তাদের উল্লেখযোগ্য কাজগুলি নিয়ে এই আর্টিকেলে আলোচনা করব। তারা মানবিক আবেগ, সমাজের বাস্তবতা এবং জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখেছেন যা পাঠকদের গভীরভাবে স্পর্শ করে। আশা করি এই আলোচনা পাঠকদের বাংলা সাহিত্যের প্রতি আরও বেশি আগ্রহী করে তুলবে এবং তাদের সৃষ্টিকর্মের প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করবে।
বাংলা ভাষার বিখ্যাত ১০ লেখক
বাংলা ভাষার বিখ্যাত ১০ লেখক নির্বাচন করা অনেক কঠিন কারণ অনেক সেরা সেরা লেখক বাংলা সাহিত্যকে যুগে যুগে সমৃদ্ধ করেছেন। তবে তাদের সবাইকে নিয়ে লিখতে গেলে এই আর্টিকেলের পরিবর্তে একটি পুরো বই লিখতে হবে। তাই আমরা আমাদের মতো করে এই অসংখ্য লেখকদের মধ্যে থেকে কাজ, সম্মাননা এবং জনপ্রিয়তার দিক বিবেচনা করে বাংলা ভাষার বিখ্যাত ১০ লেখক নিয়ে এই আর্টিকেলটি সাজিয়েছি। তাহলে চলুন বাংলা ভাষার বিখ্যাত ১০ লেখক এবং তাদের কাজের সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেই-
কাজী নজরুল ইসলাম
বাংলার বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান জাগ্রত করেছে সমাজের নিপীড়িত ও শোষিত মানুষদের। ১৮৯৯ সালে জন্ম নেওয়া বিংশ শতাব্দীর এই প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্য জীবনে যা রচনা করেছেন তার জন্য আজও তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। স্কুলের পড়া শেষ করার আগেই ১৯১৭ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী লেখালেখির জন্য ১৯২২ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে কারাবন্দী করেছিল।
কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে কবি, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সম্পাদক, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, অভিনেতা, অনুবাদক, ফৌজি, রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। ১৯২১ সালে নজরুল বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান রচনা করেন। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল বাংলার মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা। নজরুলের লেখা গানের সংখ্যা চার হাজারেরও অধিক। নজরুল ‘ধূপছায়া ‘ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা এবং তাতে একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। তার বিখ্যাত রচনা অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, সিন্ধু হিন্দোল অন্যতম। তার লেখা “চল্ চল্ চল্, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল” বাংলাদেশের রণসঙ্গীত।
কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা, গান, উপন্যাসসহ সাহিত্যের যে শাখায় হাত দিয়েছেন সেখানেই প্রচলিত ধারাকে বদলে দিয়ে নতুন পথ সৃষ্টি করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই তাকে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা দিয়ে ভূষিত করেছে। ১৯৭৪ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। তিনি ১৯৪২ সালে অসুস্থ হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবর দেওয়া হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে বাঙালি কবি, সংগীতস্রষ্টা, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। রবীন্দ্রনাথকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে গুরুদেব, কবিগুরু এবং বিশ্বকবি উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার রচনা করা “আমার সোনার বাংলা” বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ, ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সব প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে।
১৮৬১ সালে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান পরিবারে জন্ম নেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্য কর্মের জন্য মানুষের কাছে থেকে বিশ্বকবি উপাধি পেয়েছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি ও লেখক। তিনি “গীতাঞ্জলি” কাব্য গ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তিনি অবদান রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার ছিলেন।
জীবনের শেষের দিকে তিনি শারীরিক অসুস্থ থাকতেন, দুইবার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ীও থাকতে হয়েছিল তাকে। মৃত্যুর ৭দিন আগ পর্যন্ত রচনা করে গেছেন তিনি। দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম লেখক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি ছিলেন একাধারে মহাকবি, নাট্যকার, বাংলাভাষার সনেট প্রবর্তক, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের সময় থেকেই মধুসূদন কাব্যচর্চা শুরু করেন। ১৮৪৩ সালে ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে তার নামের পূর্বে ‘মাইকেল’ শব্দটি যুক্ত হয়।
মধুসূদন দত্ত বাংলার সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন, বিশেষত তার রচনায় রোমান্টিকতার প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মধুসূদন দত্তের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা হল ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। এটি একটি মহাকাব্যিক কবিতা যা রামায়ণের কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা হয়েছে। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বাংলার মহাকাব্যিক সাহিত্যে একটি অমূল্য সংযোজন। এছাড়াও, তার লেখা বীরাঙ্গনা, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য এবং কৃষ্ণকুমারী নাটকগুলি বাংলা সাহিত্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মধুসূদন দত্ত ইংরেজি ভাষায়ও দক্ষ ছিলেন এবং তার রচনায় শেক্সপীয়ারের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি নিজের জীবনেও নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তার রচনায় সেই জীবনের সংগ্রাম ও দুঃখবোধ প্রতিফলিত হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে এক স্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন এবং তার সৃষ্টিগুলি আজও পাঠকদের মুগ্ধ করে চলেছে।
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় এবং স্বনামধন্য লেখক। বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি লেখকদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ অন্যতম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর তাকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ছিলেন একাধারে ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে ব্যাপকভাবে প্রিয়। তার তৈরি করা হিমু, মিসির আলী চরিত্রগুলো আজও বাংলার যুবকদের মাঝে জনপ্রিয়।
হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম জনপ্রিয় বইগুলো- জোছনা ও জননীর গল্প, দেবী, মধ্যাহ্ন, দেয়াল, মৃন্ময়ী, আজ চিত্রার বিয়ে, কৃষ্ণপক্ষ, হিমু সিরিজ, মিসির আলী সিরিজ। তিনি প্রায় দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন- রহস্য, রোমান্টিক জনরার উপন্যাস/গল্প বেশি লিখতেন। তিনি লেখালেখির পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেছেন। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য নানা পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। জীবনের শেষভাগে হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা শহরের ধানমন্ডি এলাকায় বসবাস করতেন। ২০১২ সালের ১৯শে জুলাই নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে এই কিংবদন্তি লেখক মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পরে তাকে নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয়।
জীবনানন্দ দাশ
আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির ছবি চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। ১৮৯৯ সালে বরিশালে জন্ম নেওয়া এই কবি অল্পবয়স থেকেই কাব্যচর্চা শুরু করেন। ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে জীবনানন্দের প্রতিভার উন্মোচন ঘটে মৃত্যুর পরে পাওয়া লেখা গুলোতে। তিনি প্রায় ২০০ এর অধিক গল্প লিখেছেন। জীবনানন্দ দাশের গদ্য ও অপ্রকাশিত কবিতাগুলো সংকলনরূপে জীবনানন্দ সমগ্র (১৯৮৫-৯৬) নামে বারো খন্ডে প্রকাশ করা হয়।
জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলো – বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, রূপসী বাংলা, বেলা অবেলা কালবেলা। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অগ্রন্থিত কবিতা লিখে প্রকাশ করেছেন।
জীবনানন্দের প্রথমদিকের কাব্যে নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যধারার প্রভাব থাকলেও পরে তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। রবীন্দ্রনাথের নিবিড় প্রকৃতিচেতনাও তার কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। গ্রামবাংলার নিসর্গ ও রূপকথার জগৎ তার কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়। জীবনানন্দের তার রচনার জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতায় এই মহান কবির মৃত্যু হয়।
শামসুর রাহমান
শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) ছিলেন একজন বিখ্যাত বাংলা কবি, লেখক এবং সাংবাদিক। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান পুরোধা এবং তার রচনাশৈলী ও বিষয়বস্তু দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। শামসুর রাহমানের কবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, সমাজ, রাজনীতি, এবং মানবতা নিয়ে গভীর অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। তিনি ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তার প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে কবিতা লিখতে থাকেন এবং বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেন।
বন্দীশালায় কবিতায় মানুষের স্বাধীনতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ফুটে ওঠে। দূরত্ব প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পর্কের দূরত্ব নিয়ে লেখা একটি অনন্য কবিতা। নির্বাসনে নয়, স্বদেশে কবিতায় দেশপ্রেম ও সামাজিক চেতনার প্রতিফলন ঘটে। শামসুর রাহমানের কবিতা শুধুমাত্র সাহিত্যিক সৌন্দর্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ এবং মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। তিনি বাংলা সাহিত্যের জন্য এক অমূল্য রত্ন এবং তার রচনাগুলি আজও পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলা উপন্যাসিক এবং ছোট গল্পকার। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে পরিচিত, তিনি তার সমাজচেতনা ও মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতির জন্য বিশেষ খ্যাত। তার রচনায় সামাজিক সমস্যাগুলি তুলে ধরা হয়েছে এবং নিম্নবিত্ত ও সাধারণ মানুষের জীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দেবদাস, শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, বিন্দুর ছেলে, এবং পল্লীসমাজ। দেবদাস উপন্যাসটি তার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কাজগুলির একটি, যা এক অমর প্রেমকাহিনী হিসেবে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শ্রীকান্ত তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, যেখানে মানবজীবনের নানা দিক ও বাস্তবতা উঠে এসেছে।
শরৎচন্দ্রের রচনায় সহজ-সরল ভাষা এবং জনসাধারণের জীবনের গল্প পড়ার মধ্যে গভীর মানবিকতা ও সহানুভূতি অনুভূত হয়। তার রচনা পাঠকদের মুগ্ধ করে এবং বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) বাংলা সাহিত্যের এক অতুলনীয় লেখক। তার রচনায় প্রকৃতি, মানবজীবন এবং গ্রামের মানুষের জীবনবৃত্তান্ত ফুটে উঠেছে। তিনি ছিলেন একজন উপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার এবং তার লেখার শৈলীতে পাঠককে মাতিয়ে রাখার ক্ষমতা ছিল।
বিভূতিভূষণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ পথের পাঁচালী, যা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। এই উপন্যাসটির ভিত্তিতেই সত্যজিৎ রায় তার বিখ্যাত সিনেমা পথের পাঁচালী নির্মাণ করেন, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। এছাড়াও, তার লেখা অপরাজিত এবং আরণ্যক অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভূতিভূষণের লেখনীতে প্রকৃতির সৌন্দর্য, গ্রামের জীবন ও মানুষের মনস্তত্ত্ব অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
সত্যজিৎ রায়
সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২) ছিলেন একজন বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং লেখক। তিনি বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তার নির্মিত সিনেমাগুলি প্রায়শই গুণগত মান ও বাস্তবিকতার জন্য প্রশংসিত হয়েছে।
সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হল পথের পাঁচালী, যা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এই চলচ্চিত্রটি তাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়। এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে অপরাজিত, অপুর সংসার, চারুলতা, শতরঞ্জ কে খিলাড়ি এবং সোনার কেল্লা।
চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি সত্যজিৎ রায় ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর সৃষ্ট ফেলুদা এবং প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রগুলি বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর রচিত ফেলুদা সিরিজের গল্পগুলি আজও পাঠকদের মধ্যে অত্যন্ত প্রিয়।
সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টিগুলি শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, পুরো ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পেও এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। তিনি তার সৃজনশীলতা ও মেধার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী লেখক। তিনি মানবজীবনের গভীরতা এবং সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে তার রচনাগুলিতে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। মানিকের রচনায় সমাজের নিম্নবিত্ত ও হতদরিদ্র মানুষের জীবন অত্যন্ত বাস্তবভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা পুতুলনাচের ইতিকথা। এই উপন্যাসটি সমাজের বাস্তব চিত্র, চরিত্রের গভীরতা এবং জীবনের কঠিন বাস্তবতার এক অসাধারণ উপস্থাপন। এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস পদ্মানদীর মাঝি, যেখানে নদীর জীবনের চিত্র ও জেলেদের সংগ্রামের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
মানিকের ছোটগল্পও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেমন প্রাগৈতিহাসিক এবং দিবারাত্রির কাব্য। তার রচনায় সামাজিক সমস্যা, মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং জীবনের কঠিন বাস্তবতা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা আজও বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য ধন হিসেবে বিবেচিত হয় এবং পাঠকদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলছে।
শেষ কথা
যেমনটা আগেই বলেছি বাংলা ভাষার এত সেরা সেরা লেখকের মধ্যে থেকে বাংলা ভাষার বিখ্যাত ১০ লেখক বেছে নেওয়া অনেক কঠিন কাজ। তাই যদি আপানার প্রিয় লেখক তালিকায় না থাকে তা আমাদের কমেন্টে জানাতে পারেন। বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট লেখকরা তাদের সৃষ্টিশীলতা ও চিন্তাশক্তির মাধ্যমে এক অনন্য স্থান অধিকার করেছেন। তাদের লেখনীতে আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র, মানবতার গভীরতা এবং জীবনের বিভিন্ন দিক খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। তাদের রচনা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে। বাংলা সাহিত্যের এই মহান লেখকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং নতুন প্রজন্মের লেখকরা তাদের পথ অনুসরণ করে বাংলা সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করবে এই আশা করে এই লেখা শেষ করছি।