নাটক সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা। নাটকে আমরা মূলত অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের নড়াচড়া, কথাবার্তা ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনের বিশেষ কোন দিক বা ঘটনার উপস্থাপন দেখতে পারি। অনেক আগে থেকেই নাটকের প্রচলন রয়েছে। যা বাংলা সাহিত্যে বিশেষ এক স্থান দখল করে আছে। সাহিত্যের অন্যান্য শাখা মূলত পাঠের জন্য হলেও নাটকপ্রধানত অভিনয়ের জন্য। নাটকের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার মধ্য অন্যতম হলোঃ কাহিনী, চরিত্র, সংলাপ, পরিবেশ।
প্রতিটি নাটকে এক বা একাধিক চরিত্র থাকে। যেটির মাধ্যমে নাটক দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। বলে রাখা ভালো, নাটকের কাহিনী বা ঘটনা মূলত নাটকের এই পাত্রপাত্রী বা চরিত্রকে নির্ভর করেই গড়ে ওঠে। আজকে আমরা এই আর্টিকেলে বাংলা নাটকের ইতিহাস ও ক্রমবর্ধমান ধারা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আপনাদের সুবিধার্থে নিচে এটি সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করছি।
নাটক কাকে বলে?
নাটক বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য শাখা। যেখানে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের মাঝে এটিকে উপস্থাপন করা হয়। মূলত রঙ্গমঞ্চের সাহায্যে মানুষের সুখ দুঃখকে স্বাভাবিক অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করাকে নাটক বলে। নাটকদের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা এবং জীবনের বিভিন্ন দিককে তুলে ধরা হয়। এছাড়াও নাটক সাধারণত সমাজের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে আসে। এবং মানুষের অনুভূতি, বিশ্বাস ও সংকটকে সকলের মাঝে তুলে ধরে। আমরা সকলেই জানি নাটক সংলাপ ও অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চে প্রদর্শিত হয়ে থাকে।
নাটকের অপর নাম দৃশ্যকাব্য। নাটকে রস উপলদ্ধির বিষয়টি জড়িত বলে এটিকে দৃশ্যকাব্য বলে আখ্যায়িত করা হয়। নাটক এমন এক সাহিত্যধারা, যা প্রধানত সংলাপ ও কর্মের মাধ্যমে অভিনয়ের জন্য রচিত হয়। নাট্যকার কাহিনিকে চরিত্রদের মুখে সংলাপ এবং অভিনয়ের মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলেন। নাটক বিভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমনঃ
- ট্র্যাজেডি।
- কমেডি।
- ঐতিহাসিক নাটক।
- প্রহসন।
- সামাজিক নাটক ইত্যাদি।
এই সকল হচ্ছে নাটকের প্রকারভেদ। মূলত উল্লেখিত এইসকল ধরনের মাধ্যমে একটি নাটক পরিবেশন করা হয়। এবং প্রায় সকল নাটকে সুখ, দুঃখ, বেদনা, ভালোবাসা ইত্যাদি জাতীয় বিষয় বিদ্যামান থাকে। নাটকের মধ্য অনেক শিক্ষামূলক
বিষয়ের উপস্থিতি থাকে। নাটকের মাধমে মানুষকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। এবং সমাজের অন্যায় অবিচারকে নাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়।
বাংলা নাটকের ইতিহাস
বাংলা নাটক প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বাংলা নাটক সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন ধাপে বিকশিত হয়েছে। বাংলা নাটকের উৎপত্তি প্রাচীন কালের সময়ে হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। বলে রাখা ভালো বাংলা নাটকের প্রথম স্থায়ী নাট্যমঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল ১৭৫৩ সালে। বাংলার প্রাচীন নাট্যধারার মূল উৎস ছিল লোকসংস্কৃতি, এবং বিভিন্ন পালা ও উৎসবে নাট্যধারার অস্তিত্ব দেখা যায়। প্রথম বাংলা নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন রুশ মনীষী লেবেদেফ। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ডোমতলায় বেঙ্গলী থিয়েটারে ২৭ নভেম্বর কাল্পনিক সংবদল নামক একটি বাংলা অনুবাদ নাটক মঞ্চস্থ করা হয়।
তবে এর আগে কলকাতায় ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত দুটি নাট্যমঞ্চ ছিল। যেখানে কেবল মাত্র ইংরেজি নাটক উপস্থাপন করা হতো। লেবেদেফের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সে সময় তথা উনিশ শতকে বাঙালিরা কলকাতায় বেশ কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন। তার মধ্য রয়েছেঃ হিন্দু থিয়েটার যেটি ১৮৩১ সালে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। অপরদিকে রয়েছে ওরিয়েন্টাল থিয়েটার যেটি ১৮৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এবং জোড়াসাঁকো নাট্যশালা যা ১৮৫৪ প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও বেশ কিছু নাট্যমঞ্চের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
যেটি সেসময়ের জনপ্রিয় নাট্যমঞ্চ হিসেবে পরিচিতি ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, উনিশ শতকের শেষভাগে ঢাকা তথা বাংলাদেশেও কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মিত করা হয়। পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি, ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ, ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার ইত্যাদি। তবে ঢাকার বাইরে মুন্সীগঞ্জ শহরে জগদ্ধাত্রী নাট্যমঞ্চ নামক এক নাট্যমঞ্চ নির্মিত করা হয়, যা এখনও বর্তমান। এছাড়াও ঢাকা সহ দেশের বিভন্ন স্থানে অনেক নাট্যমঞ্চ নির্মিত হয়। বাংলা নাটকের ইতিহাস অনেক প্রাচিন এবং এটির ইতিহাস অনেক বড় যা এক কথায় আলোচনা করে বোঝানো সম্ভব না। বর্তমান সময়ে নাটক শুধু মঞ্চনাটকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটিকে টেলিভিশন, রেডিও এবং ডিজিটাল মাধ্যমেও উপস্থাপনা করা হয়।
বাংলা নাটকের বিকাশ
বাংলা সাহিত্যে নাটক একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। বাংলা নাটকের বিকাশ অনেক প্রাচিন এবং পুরনো। বাংলা নাটকের বিকাশ একটি দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অংশ। বর্তমান সময়ে আধুনিক মঞ্চ থেকে শুরু করে নানা সামাজিক মাধ্যম এবং টেলিভিশনে নাটক বিকশিত করা হচ্ছে। এবং সেইসাথে সময়ের পরিবর্তনে নাটকের আঙ্গিক, ভাষা ও বিষয়বস্তুতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আমরা প্রায় সকলেই জানি বাংলায় নাটকের সূচনা হয় প্রাচীন লোকনাট্যের মাধ্যমে। আগের যুগে লোকনাট্য ও পালাগানের মাধমে নাটক পরিবেশন করা হতো। এবং তার মধ্য অন্যতম ছিল যাত্রা। যাত্রা বাঙালিদের ঐতিহ্যের মধ্য অন্যতম হিসেবে পরিচিত।
যাত্রার মাধ্যমে নাটক দর্শকদের মাঝে উপস্থাপন করা হতো। মজার বিষয় হচ্ছে লোক সংস্কৃতি ভিত্তিক নাট্যধারা গ্রামীণ সমাজে বিশেষ ভাবে প্রচলিত ছিল। বলে রাখা ভালো ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা নাটক একটি নতুন দিগন্তে প্রবেশ করে। এবং বিশ শতাব্দীতে বাংলা নাটক আরও নতুন ভাবে বিকশিত হয়। হেরাসিম লেবেডেফ ১৭৯৫ সালে প্রথম দুইটি নাটক বাংলায় অনুবাদ করে এদেশীয় পাত্র-পাত্রীর দ্বারা অভিনয় করান। যেটি হচ্ছে The Disguise ও Love is the best Doctor নামক দুইটি জনপ্রিয় নাটক। উল্লেখিত এই দুইটি নাটক সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে, মূলত এগুল অনুবাদক নাটক। সেসময় বাংলা ভাষার কোন নাটক লেখা হয়নি।
প্রথম বাংলা মৌলিক নাটক তারাচরণ শিকদার কর্তৃক ভদ্রার্জুন। যেটি ১৮৫২ সালে রচিত করা হয়। এই নাটকের বিষয় অর্জুন কর্তৃক সুভদ্রা হরণের কাহিনি। অপরদিকে ১৮৫২ সালে যোগেন্দ্রচন্দ্র গুপ্ত রচিত কীর্তিবিলাস বাংলা ভাষার প্রথম বিয়োগান্তক বা ট্র্যাজেডি নাটক হিসেবে প্রকাশিত করা হয়। যেটি মূলত সপত্নীপুত্রের প্রতি বিমাতার অত্যাচারের কাহিনি অবলম্বনে রচিত করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলা নাটক নানা ভাবে প্রকাশিত করা হয়েছে। যেটি ব্যপক ভাবে দর্শকদের মাঝে সারা ফেলতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে নাটকের স্বর্ণযুগ হিসেবে ১৯৮০-৯০ দশককে ধরা হয়। বাংলা নাটকের বিকাশ এক দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। লোকনাট্য থেকে শুরু করে আধুনিক মঞ্চনাটক, থিয়েটার ও টেলিভিশনে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই নাটকের গুরুত্ব অপরিসীম।
নাটকের শ্রেণীবিভাগ
নাটককে বিভন্ন শ্রেণীবিভাগে বিভক্ত করা যায়। যেটি একটি নাটকে সুন্দর ভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। নাটকের শ্রেণিবিভাগ মূলত একটি নাটকের বিষয়বস্তু, রচনাশৈলী ও উপস্থাপনার ধরন। নানারকম বিষয়বস্তু অনুসারে নাটককে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে।
বিভিন্ন ধরণের নাটক বিভিন্ন ধরণের অনুভূতি, উদ্দেশ্য এবং বার্তা প্রদান করে। মূলত এইটাকেই নাটকের শ্রেণিবিভাগ বলা হয়। শ্রেণীবিভাগ অনুসারে নাটকে নানা ভাবে বিভক্ত করা হয়েছে যেমনঃ
- বিষয়বস্তুর দিক থেকে।
- রসের দিক থেকে।
- অভিনয়ের দিক থেকে।
- আয়তন এবং আকার বা অঙ্কসংখ্যা অনুসারে।
- রচনা রীতি অনুসারে।
- ইংরেজি আদর্শের দিক থেকে।
- ভাবের দিক থেকে ইত্যাদি।
প্রকৃতপক্ষে নাটকের শ্রেণীবিভাগের সুনির্দিষ্ট কোন কাঠামো অথবা ভিত্তি নেই বললেই চলে। যে কোন আকার আঙ্গিকের মাধ্যমে নাটকের শ্রেণীবিভাগ করা যায়। তবে ওপরের উল্লেখিত শ্রেণীবিভাগ নাটকের জগতে বেশ আলোচিত। প্রায় সকল নাটকের কাহিনীতে উল্লেখিত বিষয়বস্তু ফুটে তোলা হয়। তবে মজার বিষয় হচ্ছে উল্লেখিত নাটকের শ্রেণীবিভাগকে আবার নানা ভাবে বিভক্তি করা যায়। যেটি নাটকের জগতে বেশ কার্যকরী ভুমিকা পালন করে থাকে।
বাংলাদেশি নাটকের শ্রেণীবিভাগ
বাংলাদেশি নাটক মূলত বৈচিত্র্যময়, বিষয়বস্তু ও ধরণের জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশি নাটক দীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বহন করে আসছে। যেটির মাধ্যমে বাংলার ঐতিহ্য, নানা ঘটনা ও অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের মাঝে উপস্থাপন করা হয়। নাটককে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা যায়। তবে আগের যুগের নাটক এবং বর্তমান যুগের নাটকের উপস্থাপনার মধ্য বেশ ব্যতিক্রম রয়েছে। এখনকার নাট্যচর্চা মূলত লোকনাট্য, সাহিত্যনির্ভর নাটক এবং আধুনিক থিয়েটারের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে।
বিভন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টেলিভিশনের মাধ্যমে বর্তমান আধুনিক যুগে নাটক দর্শকদের মাঝে উপস্থাপনা করা হয়। তবে নাটক উপস্থাপনার ব্যতিক্রম ঘটলেও নাটকের শ্রেণীবিভাগ ও ধরনের কোন পরিবর্তন হয়নি। নাটক অনেক দেশের অনেক ধরনের হয়ে থাকে। বাংলাদেশি নাটকও এটির ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশি নাটক অনেক শ্রেণীবিভাগের হয়ে থাকে। যেমনঃ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধমূলক নাটক, সামাজিক নাটক, ইতিহাস ঐতিহ্যভিত্তিক নাটক, অনুবাদ বা রূপান্তরিত নাটক ইত্যাদি।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পরবর্তীতে নাট্যাঙ্গানে অনেক পরিবর্তনের লক্ষ্য করা যায়। অনেক নাট্যকার তাদের নাটকে মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর বর্বরতা, স্বাধীনতা উত্তর পরিস্থিতি এই জাতীয় বিষয়কে নিয়ে নাটক রচিত করছেন। এইসকল ঘটনা ছারাও বর্তমান সময়ে অনেক বিষয়কে কেন্দ্র করে নাটক নির্মিত করা হচ্ছে। যেটি দর্শকদের মাঝে ব্যপক সারা ফেলছে। তবে বলে রাখা ভালো, বর্তমানে বাংলাদেশে যে নাট্যধারা সৃষ্টি হয়েছে তাতে মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া, মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী চেতনা এবং সামাজিক বৈষম্য তুলে ধরার প্রচেষ্টা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা নাটক
বাংলা নাটককের উৎপত্তি প্রাচিন কাল থেকেই। সেসময়ের বিনোদন জগতের মূল উৎস ছিল নাটক। প্রাচীন যুগের সময়ের নাট্যরূপ অধিকাংশই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের ওপর ভিত্তি করে অনেক নাটকের কাহিনী গঠন করা হতো। এবং সেটিকে অভিনয়ের মাধ্যমে নাটকের মঞ্চে উপস্থাপন করা হতো। প্রাচীন বাংলার নাট্যধারা মূলত সংস্কৃত নাটকের ছায়ায় গড়ে উঠেছিল। বলে রাখা ভালো, ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রের জনক ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র বাংলা নাটকের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এবং সেসময়ের বেশিভাগ নাটক রাজসভা এবং ধর্মীয় মঞ্চে উপস্থাপন করা হতো।
এছাড়াও প্রাচিন যুগে লোকনাট্য ও ধর্মীয় নাটক বেশ জনপ্রিয় ছিল। বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন লোকনাট্যরীতি প্রচলিত ছিল। যেমন যাত্রাপালা, পালাগান, গম্ভীরা, কবিগান, আলকাপ, ঢপ, নাটুয়া নাচ ইত্যাদি। তবে এইসকল নাটকে পৌরাণিক, ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়াবলী উপস্থিত থাকতো। প্রাচিন যুগের নাটকের সাথে তুলনা করলে মধ্যযুগের বাংলা নাটক বড় ধরনের পরিবর্তন ও অগ্রগতি দেখা মিলবে। মজার বিষয় হচ্ছে এই সময় বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং তার ফলে সংস্কৃতির উপরও এর প্রভাব পড়ে। ফলে সেসময় বাংলা নাটক থেকে শুরু করে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ইসলাম ধর্মের অনেক বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়। যেটির ফলে বাংলা নাটককের আরেকটি নতুন বিষয়বস্তু যোগ হয়।
ঊনবিংশ শতকের বাংলা নাটক
ঊনবিংশ শতকের বাংলা নাটকে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা মেলে। এসময় বাংলা নাটকের জগতে নানা ধরনের নাটকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই সময়ের নাটক সামাজিক সংক্রান্ত বিষয়গুলো উপস্থাপন করে। এবং বাংলার জীবন ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক প্রতিবিম্বিত করে। ঊনবিংশ শতককে বাংলা নাটকের এক বিশিষ্ট যুগ হিসেবে বিবেচিত করা হয়। এইসময়ের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ধারা ছিল নাটক। ঊনবিংশ শতকে বেশ কিছু জনপ্রিয় নাট্যকার নাটক রচিত করেছেন। জনপ্রিয় নাটক রচিতার মধ্য রয়েছেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র ইত্যাদি। এইসকল রচিতার নাটক সেসময় বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচিত শর্মিষ্ঠা ও পদ্মাবতী নাটকটি সেসময় ব্যপকভাবে দর্শকদের আকৃষ্ট করে।
অন্যদিকে গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটকও বেশ খ্যতি অর্জন করে। বলে রাখা ভালো গিরিশচন্দ্র ঘোষ বাংলা নাটক প্রতিষ্ঠাতার অন্যতম ব্যক্তিত্বের মধ্য একজন। তাঁর রচিত চৈতন্যলীলা, মীনা ও বদনলাল বিশেষভাবে পরিচিত। এছাড়াও দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ সহ সেসময়ের অনেক নাটক রচিতার নাটকগুলো বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে এই সময়ে আরও অনেক লেখক ও নাট্যকার ছিলেন যারা বাংলা নাটকের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯শতকের বিশেষ খ্যতিমান নাটকের মধ্য জনপ্রিয় ছিল সার্কাসের যাত্রা, কালীনাথ ও নন্দলাল। এইসকল নাটকের মাধ্যমে নাটকের রচিতা শুধু দর্শকদের বিনোদনের জন্য প্রস্তুত করেনি, বরং এটির মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
বিশ শতকের বাংলা নাটক
বিশ শতকের বাংলা নাটক একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ধারা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই সময়ে বাংলা নাটকে অনেক পরিবর্তনের লক্ষ্য করা যায়। যেমন নাটকের বিষয়বস্তু, আঙ্গিক, উপস্থাপনা পদ্ধতি এবং থিয়েটারের নান্দনিকতা সবকিছুতেই ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। বিশ শতকের বাংলা নাটক কাব্যধর্মিতা, সামাজিক সচেতনতা, রাজনৈতিক আন্দোলন এবং বাস্তবধর্মিতার মাধ্যমে নানা ভবে বিকশিত হয়। বলে রাখা ভালো, এই শতকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতীকী নাটক থেকে শুরু করে গণনাট্য আন্দোলন, দেশভাগ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক নাটকের উদ্ভব ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতীকবাদ, দার্শনিকতা, মানবতাবাদ এবং কাব্যনাট্যের মাধুর্য। বিশ শতকে বাংলা নাট্যচর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্যের মধ্য ছিল বাস্তববাদিতা, আধুনিকতা, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, প্রায়োগিক থিয়েটার ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সেসময়ের সেরা নাট্যকারের মধ্য অন্যতম একজন রচিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকগুলি বাংলা সাহিত্যের মূলধারার মধ্যে পড়ত। রবীন্দ্রনাথের রচিত রক্তকরবী, ডাকঘর, চিত্রাঙ্গদা, মুক্তধারা ইত্যাদি নাটকগুলি তার নিজের মানসিকতার ওপর ভিত্তি করে রচিত করা হয়েছে। এবং এই সকল নাটক দর্শকদের মাঝে ব্যপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে এসেছে। বিশ শতকের বাংলা নাট্যচর্চার ধারা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এবং এইসময়ের বাংলা নাটকের বেশ কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা নাটক একটি নতুন ইতিহাস গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ফলে এর মাধ্যমে বর্তমান সময়েও এই ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। এবং নতুন নতুন নাট্যকার ও নাট্য প্রতিষ্ঠানগুলি এই ধারা অনুসরণ করে নিজেদের নাটক সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা থিয়েটারকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা নাটক
স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলা নাটক আরেকটি নতুন স্থান অর্জন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নাটকের ধারার পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মানবিক সংকটে বেশ পরিবর্তন ঘটে। স্বাধীনতার পরবর্তীতে বাংলা নাটকগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, সামাজিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্রামবাংলার চিত্র এবং আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রভাবকে তুলে ধরা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলা নাটকের অনেক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও প্রভাব, রাজনৈতিক বাস্তবতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, পরীক্ষামূলক ও আধুনিক নাট্যরীতি ইত্যাদি। দেশ স্বাধীনের পরে সকল প্রকার নাটকে স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরা হয়। এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও সমাজ পরিবর্তনের বিষয়বস্তুের চিত্র নাটকে উল্লেখ করা হয়।
এবং এইসকল বিষয় ছারাও প্রচলিত নাটকের বাইরে নতুন আঙ্গিক ও ধারা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। এবং নাটকের ধারার কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। স্বাধীনতার পর মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রধান ধারা তৈরি হয়। মজার বিষয় হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নাট্যগোষ্ঠী গড়ে ওঠে, এবং তারা নিয়মিত নাটক মঞ্চে পরিবেশন শুরু করেন। বাংলা নাটকে উল্লেখযোগ্য নাট্যগোষ্ঠীর অবদান ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নাট্যসম্প্রদায় ১৯৬৮ সাল থেকে সারা দেশে আধুনিক মঞ্চনাটকের প্রচলন শুরু করে। এবং দেশে নাটককে উন্নতির দিকে অগ্রসর করার জন্য থিয়েটার সহ বেশ কিছু উন্নত প্রযুক্তি স্থাপন করে। যেটির মাধ্যমে বাংলা নাটক এক নতুন ধারার সূচনা শুরু করে।
শেষ কথা
বাংলা নাটকের প্রচলন শুরু প্রাচীনকাল থেকেই। বাংলা নাটক বিনোদন জগতের একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। আগের যুগের নাটক এবং বর্তমান যুগের নাটকের মধ্য বেশ পার্থক্য রয়েছে। বর্তমান সময়ে নাটক বেশ উন্নত এবং সময়ের সাথে এটি বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
আমরা এই আর্টিকেলে বাংলা নাটকের সকল বিষয়বস্তু উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। আসা করছি এটি আপনাদের উপকারে আসবে। আমরা নিয়মিত এইসকল প্রয়োজনীয় তথ্য আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে থাকি। কাজেই যেকোনো ধরনের প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন ধন্যবাদ।