বাংলাদেশ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে এবং পরের পটভূমি

কেমন ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতার আগে এবং পরের পটভূমি আপনি কি জানেন? যদি না জেনে থাকেন তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কেননা আজকে আমরা এইসকল বিষয় নিয়ে এই আর্টিকেলে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আমরা সকলেই জানি, ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হয়। এবং দেশ বিভক্তের পর থেকেই শুরু হয় আরেকটি নতুন অধ্যায়। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে দ্বন্দ্ব। শুরু হয় নিজেদের সঠিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। বলে রাখা ভালো পূর্ব পাকিস্তান যেটি বর্তমান বাংলাদেশ। এবং পশ্চিম পাকিস্তান যেটি হলো বর্তমান পাকিস্তান।

এই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে নিয়ে একটি জটিল সমস্যা তৈরি হয়। এর কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের আচার আচরণ এবং ভাষাগত দিক দিয়ে ছিল ভিন্ন। এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগনদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা নানা ভাবে নির্যাতন করতো। এবং সঠিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতো। আজকে আমরা এই আর্টিকেলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে কিভাবে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশি পরিচয় পেয়েছি সেটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। সেইসাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে এবং পরের পটভূমি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। তাহলে আসুন তা জানা যাক।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার আগে পটভূমি

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে অনেক ভয়াবহ সমস্যার মধ্য দিয়ে পারি দিতে হয়েছে। এর কারণ নিজেদের সঠিক অধিকার না পাওয়া। আমরা সকলেই জানি দেশ বিভক্তের পরে নানা সমস্যা দেখা মেলে। তার মধ্য অন্যতম সমস্যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান গঠন। বলে রাখা ভালো, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আচরণ ও ভাষাগত দিকদিয়ে ছিল ভিন্ন। এবং তাদের ভাষা ছিল বাংলা। মূলত এখান থেকেই শুরু হয় গণ আন্দোলনের নতুন মোর।

কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলাকে সঠিক অধিকার দিতে চাইতো না। এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের তারা নানা ভাবে নির্যাতিত করতো। যেটি একসময় পূর্ব পাকিস্তানি জনগণদের কাছে একটি অসহ্যের প্রতিক হয়ে দারায়। স্বাধীনতার আগে বাঙালিদের অনেক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পারি দিতে হয়েছে। যা বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আজকে তারই কিছু ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন

বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন পুরো বাংলায় তাদের প্রভাব বিস্তার শুরু করে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বলতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলগুলোতে ব্রিটিশ সরকারের শাসন ও প্রভাবকে বোঝায়। এই সময় ব্রিটিশদের শাসন প্রায় দুই শতাব্দী স্থায়ী ছিল। এবং তাদের শাসনের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রভাব ফেলেছিল। তাদের শাসন চলাকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত দেশগুলোর সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনভার পরিচালনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছিল।

যার প্রধান ছিলেন ভাইসরয়। ভাইসরয় মূলত ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি ছিলেন। এবং তিনি ভারতের সামরিক ও বেসামরিক বিষয়গুলির তত্ত্বাবধান করতেন। বাংলাদেশ সে সময় তৎকালীন পূর্ব বাংলা হিসেবে পরিচিত ছিল। যেটি ব্রিটিশ ভারতে একটি অংশ ছিল। এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে বাংলাদেশসহ পুরো ভারত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আওতায় ছিল। এবং তারা নানা ভাবে তাদের শাসন ব্যবস্থার কার্যক্রম শুরু করেছিল। এবং মজার বিষয় হচ্ছে, ব্রিটিশরা একদিকে অর্থনৈতিক শোষণ চালালেও, ভারতীয়দের মধ্যে একটি রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।

ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে ভারত গঠন

আমরা সকলেই জানি ব্রিটিশরা ভারতে প্রায় ২০০ বছর শাসন করে। এবং এই দুইশ বছরে তারা তাদের প্রভাব সকল জায়গায় বিস্তার করে। ১৯৪৭ সালের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ব্রিটিশদের শাসন ব্যবস্থার ফলে এই সময়ে ভারত উপমহাদেশে বিশাল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটিশদের শাসন আমলের এক পর্যায়ে তারা তাদের ক্ষমতাকে ছারতে বাধ্য হয়। এর কারণ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশদের পক্ষে উপমহাদেশে শাসন চালানো অসম্ভব হয়ে পরেছিল। মূলত সেই কারণেই তারা ভারতকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। তবে স্বাধীনতা পাওয়ার আগে ভারতীয়রা অনেক সংগ্রামের এবং নিজেদের সঠিক অধিকার আদায়ের জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করে।

তার মধ্য সর্ব প্রথম ও অন্যতম পদ্দক্ষেপ ছিল ১৮৫৭ সালের বিপ্লবী আন্দোলন। এই আন্দোলনটি ভারতের প্রথম এবং বৃহত্তম বিদ্রোহের আন্দোলন ছিল। এই বিদ্রোহ ভারতের জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্কিয়তা জাগাতে সহায়ক হয়েছিল। পরবর্তীতে ভারতীয়রা অনেক অন্যায় অত্যাচার সহ্যের পরে তারা ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষ শহিদ হয়েছেন। এবং জানা যায়, ভারতে প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ বাস্তুহারা হন। ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পরে, ভারতকে দুই অংশে ভাগ করা হয়। একটি ভারত ও আরেকটি পাকিস্তান।

পরবর্তীতে পাকিস্তানকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। দেশ বিভক্তের পরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্য নানা রকমের দ্বন্দ্ব চলমান থাকে। তবে পরিশেষে অনেক রক্ত, অন্যায় অত্যাচার সহ্য করার পরে ভারত একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ব্রিটিশ রাজশক্তির শাসনকর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। যেটি ভারতীয় সকল মানুষের কাছে একটি স্মরণীয় দিন হিসেবে পরিচিত।

দ্বি-জাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান গঠন

দ্বি-জাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান গঠনের ইতিহাস বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই বিষয়টি সকল শ্রেণীর মানুষের জানা উচিত। দ্বি-জাতিতত্ত্ব হলো ভারতীয় উপমহাদেশের একটি রাজনৈতিক ধারণা। যেটি মূলত মুসলিম লীগ এবং বিশেষ করে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল। দ্বি-জাতিতত্ত্ব মূল ভিত্তি ছিল, মুসলমান এবং হিন্দু দুটি আলাদা জাতি, যাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, সামাজিক আচার-আচরণ এবং ইতিহাস ভিন্ন এই ভিন্নতার কারণে, উভয় জাতির জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা উচিত। সেই ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান গঠন করা হয়। পাকিস্তান মুসলিম লীগ ২৩ মার্চ, ১৯৪০ সালে লাহোরে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যা ভবিষ্যতে পাকিস্তান গঠনের ওপর ভিত্তি স্থাপন করে। এই প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠন করার কথা জানানো হয়েছিল।

এই প্রস্তাবে মুসলিম লীগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিল। মুসলিম লীগ দ্বি-জাতিতত্ত্বকে ভিত্তি করে ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের সমর্থন আদায় করে এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। এবং ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনভার হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ৩ জুন, ১৯৪৭ তারিখে ভারত বিভাজনের পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার ভারতকে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। একটি ভারত ও আরেকটি পাকিস্তান। এবং পাকিস্তানকেও দুইটি অংশে বিভক্ত করা হয়। একটি পূর্ব পাকিস্তান ও আরেকটি পশ্চিম পাকিস্তান। পরবর্তীতে অনেক ঝামেলার পরে ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ তারিখে পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য

ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি দেশ প্রতিষ্ঠিত করা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। যখন ব্রিটিশ ভারত বিভাজন সংঘটিত হয়েছিল। এবং এই বিভাজনের মাধ্যমে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বৈষম্যের দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানিদের দেশ বিভক্তের পর থেকেই অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যর শিকার হয়েছেন। পাকিস্তান সরকার প্রথম থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি দুর্বল মনোভাব প্রকাশ করে। ফলে বেশিরভাগ প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূতের দখলে থাকে। বলে রাখা ভালো, পূর্ব পাকিস্তানের বাইরে বস্তুত বৈষম্য এবং অত্যাচার সম্পর্কে বিভিন্ন আন্দোলন ও বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছিল। যেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে নির্দেশক হিসেবে সাহায্য করেছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা সকল ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তানিদের নানা ভাবে নির্যাতন করে আসছিল। পাকিস্তান গঠনের পরে পূর্ব পাকিস্তান যেটি (বর্তমান বাংলাদেশ) পাকিস্তানের একটি প্রধান অংশ ছিল। এর কারণ হলো, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার বৈচিত্র্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক উন্নত ছিল। তাই পাকিস্তান সরকার সেসময় পূর্ব পাকিস্তানের সকল অর্থনৈতিক দিক নিজেদের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে আসছিল। এবং তা পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পরে। পূর্ব পাকিস্তানিদের নানা ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা নির্যাতন ও অবিচারের শিকার করায় সেটি একসময় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে খোব সৃষ্টি হয়, এবং সেটি একপর্যায়ে গণ আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে অবসান ঘটে।

ভাষা আন্দোলন

ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য একটি। পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেকিনা নিজের মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। এই ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে শুরু হয়েছিল। এবং এটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান কারণ হয়ে উঠেছিল। এই ভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণদের সঠিক অধিকার নিশ্চিত করা। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদের নানা ভাবে নির্যাতিত করে আসছিল। বলে রাখা ভালো, প্রায় সকল দিক দিয়েই পাকিস্তান সরকারের থেকে নানা রকমের অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হতো বাঙালিরা।

এবং আমরা সকলেই জানি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রধান ভাষা ছিল বাংলা। এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে সকল দিক দিয়েই পূর্ব পাকিস্তানিদের আচার আচরণ ও ভাসাগত দিক ছিল ভিন্ন। যদিও পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা ছিল বেশি। এবং পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক সহ নানা দিক দিয়ে ছিল বেশ উন্নত । ১৯৪৮ সালের এক সমাবেশে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করে। এবং তাদের এই ঘোষণাকে পূর্ব পাকিস্তান্দের জনগণ প্রতিবাদ করে এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।

মূলত এখান থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৫২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি এই আন্দোলনটি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সেদিন ঢাকা সহ দেশের নানা স্থানে সকল বাঙালিগণ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও সমাবেশ গড়ে তোলে। ছাত্র, শিক্ষক এবং সাধারণ মানুষ ঢাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ করে। সেই আন্দোলনটি ঠেকাতে পাকিস্তান সরকার নির্মম ভাবে বাঙালিদের ওপর গুলি বর্ষণ করে। এবং সেই দিন পুলিশের গুলিতে প্রায় অনেক ছাত্র ও সাধারণ মানুষ নিহত হন। এই ঘটনাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনা

মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে। এই আন্দোলনের মূল সূত্রপাত ঘটে ভাষা আন্দোলন থেকে। ভাষা আন্দোলনে হাজারো বাঙালি বিনা অপরাধে প্রাণহানি হয়। এবং সেটিকে প্রতিবাদ করতে বাংলার দামাল ছেলেরা একটি গণ আন্দোলন গড়ে তোলে। এবং সেটি থেকেই সৃষ্টি হয় নিজেদের সঠিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। বাঙালিদের আন্দোলনকে দমন করাতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঢাকায় একটি অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি নির্মম অভিযান চালায়। এবং এই অভিযানে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করা এবং বাঙালি নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা।

এই রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম ভাবে বাঙালিদের ওপর হামলা চালায় এবং অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এবং তার এই ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার একটি অনুপ্রেরণা যোগাতে সাহায্য করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই প্রেক্ষাপটে, ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক সহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ সশস্ত্র প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করেন। এই মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামটি প্রায় ৯ মাস ধরে চলমান থাকে। এই সংগ্রামে প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি বাঙালি বিনা অপরাধে প্রাণ হারান। পরিশেষে অনেক রক্তের বিনিমনে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। এবং আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাই।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরের পটভূমি

বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পরে দেশটি একটি নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করে দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করা কিন্তু সহজ ছিল না। বাংলার দামাল ছেলেদের সাহসিকতায় এবং হাজারো রক্তের বিনিময়ে আজকে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারছি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দেশটিতে নানা রকমের সমস্যার মধ্য দিয়ে পারি দিতে হয়েছে। এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর, বাংলাদেশ সরকার নতুন জাতির জন্য বিভিন্ন রকমের উদ্যোগ গ্রহণ করে। যেটি দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর ছিল। নিচে আমরা দেশ স্বাধীনের পরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছিঃ

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করা

দেশ স্বাধীনের পরে বাংলাদেশের জনগণদের নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে। স্বাধীনতা পাওয়ার পর বাংলাদেশ একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এসময় দেশে অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্য সংকট, এবং শিল্প সহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। এবং সেটিকে ঠিক করতে তৎকালীন সরকার পুনর্গঠনের জন্য কাজ শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের পরে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করা তৎকালীন সরকারের একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি সহ নানা বিষয়কে পুনর্গঠন করা সহজ কথা ছিল না।

তবে অনেক ঝামেলাকে পিছনে ফেলে সকল কার্যক্রমকে সঠিক ভাবে পুনর্গঠন করতে সরকার সক্ষম হয়েছিল। এইসকল কার্যক্রমের সাথে সরকার দেশকে উন্নত করতে নানা রকমের পদক্ষেপ গ্রহন করে। তৎকালীন সরকার দেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করেন। সেইসাথে দেশের কৃষি, শিল্প, এবং সেবা খাতের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সরকার এইসকল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। তবে সেসকল চ্যালেঞ্জেকে উপেক্ষা করে দেশের জনগণের দৃঢ়তা এবং প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগোতে সক্ষম হয়েছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। দেশ স্বাধীনের পরে দেশ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। তবে এই পুনর্গঠনে তৎকালীন সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা সহজ ছিল না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয় এবং সমাজতান্ত্রিক ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হয়। তবে অর্থনৈতিক, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে সরকারকে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করা হয়।

এবং এই হত্যাকাণ্ডের পরে দেশে সামরিক শাসন শুরু হয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। বলে রাখা ভালো, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সামরিক শাসন চলতে থাকে। এবং ১৯৮২ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসেন এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। নানা রকমের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পরবর্তীতে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতন ঘটে। এছাড়াও স্বাধীনের পরে দেশে নানা রকমের জটিল রাজনৈতিক সমস্যার দেখা মেলে। যা ইতিহাসে আজও স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা আছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন

স্বাধীনের পরে দেশে নানা রকমের জটিল অস্থিরতা দেখা মেলে। তাই অনেক ধরনের অস্থিরতাকে উপেক্ষা করে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার নানা রকমের উন্নয়নমূলক কাজ করে এসেছেন। তার মধ্য অন্যতম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কেননা একটি দেশ পরিচালিত করার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিক গুরুত্বপূর্ণ বাহক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো কৃষি শিল্পের উন্নয়ন। তাই সরকার দেশের কৃষকদের জন্য সহায়তা ও সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। এবং সেইসাথে তাদের আয় বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রোজেক্ট চালু করছেন।

অন্যদিকে শিল্প উন্নয়ন, বিনিয়োগ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কাজ শুরু করেছেন। এবং বিশেষ করে সরকারী প্রকল্পের দিক দিয়ে বাংলাদেশের সরকার বিভিন্ন প্রকল্প এবং প্রচেষ্টা চালু করেছে। যেটির ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে আসছে। এবং সেইসাথে গার্মেন্টস শিল্প, রেমিট্যান্স, এবং ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাস এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে পারি দিতে হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে বেশ কিছু সংঘর্ষ ও প্রচেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন করে বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বলে রাখা ভালো, প্রথম স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। এবং মজার বিষয় হচ্ছে, এটিই ছিল প্রথম কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।

ভারত ও ভুটান ছারাও সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ইত্যাদি সহ আরও অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু মুসলিম দেশ ধীরগতি দেখালেও পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পর মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। স্বাধীনতার পরে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির একটি বড় সাফল্য ছিল। এবং এটি বাংলাদেশকে বৈশ্বিক মঞ্চে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে এসেছে।

শেষ কথা

বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের থেকে নানা রকমের নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় একসময় বাংলার দামাল ছেলেদের কঠোর সাহসিকতার মাধ্যমে নিজেদের সঠিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম গড়ে তোলা হয়। এবং তা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের রূপ নেয়। আমাদের দেশকে ধ্বংস করার জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা করে এসেছে পাকিস্তানি স্বৈরাচার বাহিনীরা।

তবে বাঙালিদের অদম্য সাহসিকতার মাধ্যমে আজ আমরা স্বাধীন রাষ্ট্রে বসবাস করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের এই স্বাধীনতা ধরে রাখতে আমাদের সকলের সহযোগিতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আসা করি আমাদের এই আর্টিকেলটি আপনাদের সঠিক সময়ে কাজে আসবে। আমাদের এই আর্টিকেলটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। এবং নিয়মিত আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন ধন্যবাদ।

Taufik

হ্যালো বন্ধুরা, আমি তৌফিক বিডিইবুক সাইটের একজন কন্টেন্ট লেখক। আমি মূলত বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বাংলা ভাষার বই নিয়ে লেখালিখি করে থাকি। বিডিইবুক সাইটে আমার লেখা পড়লে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং বাংলা ভাষার বই সম্পর্কে জানতে পারবেন। আমি সব সময় সঠিক তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করে থাকি যা আপনারা আমার লেখা পড়লেই বুজঝতে পারবেন।

Recent Posts

১২০+ বিখ্যাত হুমায়ূন আহমেদ এর উক্তি ও বাণী

হুমায়ন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় নাম। হুমায়ন আহমেদের লেখা সকল বই, বইপ্রেমিদের নানা ভাবে…

7 দিন ago

সেরা ১০০+ কাজী নজরুল ইসলাম এর উক্তি ও বাণীসমূহ

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলের একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি। তার লেখা সকল কবিতা পাঠকদের নানা ভাবে…

7 দিন ago

নাটক ও উপন্যাসের মধ্যে পার্থক্য কিছু মিল ও অমিল

নাটক ও উপন্যাস পছন্দ করে না এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই দেখা যায়। মানুষের বিনোদন…

1 সপ্তাহ ago

আঞ্চলিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য ও কিছু আঞ্চলিক উপন্যাসের উদাহরণ

বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস জগতের গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হচ্ছে আঞ্চলিক উপন্যাস। আঞ্চলিক উপন্যাসের মধ্যে কোন একটি…

1 সপ্তাহ ago

রাজনৈতিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য ও সেরা কিছু রাজনৈতিক উপন্যাস

রাজনৈতিক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এমন একটি শাখা যেখানে কোনো রাজনৈতিক ঘটনা, রাজনৈতিক পরিবেশ, রাজনৈতিক ব্যক্তি,…

2 সপ্তাহ ago

জনপ্রিয় ইসলামিক উপন্যাস ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা

ইসলামিক উপন্যাস মূলত মুসলিম ধর্মের জনসাধারণের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এর কারণ…

2 সপ্তাহ ago