সবুজ শ্যামল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। এ দেশের সমুজ শ্যামল মাঠ, বিস্তীর্ণ ম্যাংগ্রোভ বনভূমি, আঁকাবাঁকা নদনদী, সুবিশাল পাহাড়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর যা দেখলে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। এ দেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ দেখার জন্য যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ছুটে আসে। এ জন্যে বাংলার বিখ্যাত কবি এ দেশের অপরূপ সৌন্দর্যে আবেগ-মুগ্ধ হয়ে ‘রূপসী বাংলা’ নামে অভিহিত করেছেন। ছয় ঋতুর এ দেশে ঋতু বৈচিত্রের এক অপরূপ লীলাভূমি যা আপনাদের মুগ্ধ করবে। ছয় ঋতুর পালা বদলের ফলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একেক সময় তার আলাদা রূপ প্রদর্শন করে থাকে। বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে যেমন পৃথীবির বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক ছুটে আছে, তেমনি ভাবে বাংলাদেশের এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে চলে।
অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের এই বাংলাদেশ। এ দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-টিলা, বন-বনানী, সমতল ভূমি মিলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এক বিচিত্র অপরূপ সমারোহ। বাংলাদেশে ছয় ঋতুর দেশ হওয়ায় এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঋতুবৈচিত্র্যের মধ্যে চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রতিটি ঋতু পরিবর্তনের সাথে এর প্রাকৃতিক বৈচিত্র আলাদা রূপ ধারন করে। এখানে গ্রীষ্মের তীব্র রোদের মাঝে বিশাল বট বৃক্ষের স্নিগ্ধ ছায়া, নীলাভ নদীর বুকে জেগে উঠা বালুচরে খেয়ালি দুপুরের মাতাল গ্রীষ্মের হাওয়া যেনো মুগ্ধ করে দেয়। অপরদিকে বর্ষা কালে নদ নদী পানিতে ভরে একাকার হয়ে যায়, তখন নদীর বুকে চাদের আলো যেনো এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
গ্রীষ্মের বুকফাটা বাংলাদেশ বর্ষায় ফিরে পায় তার অকূল যৌবন। শরৎএ সবুজের বুকে সাদা কাশফুল এবং নীলাভ স্বচ্ছ আকাশ যেনো প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্য। হেমন্তে পাকা ধানের সোনালী রঙ্গে যেনো কৃষকের মুখে একরাস হাসি বয়ে আনে বাংলার মাঠে ঘাটে আনন্দের ছোয়া। এরপর শীত আসে একপা দুপা করে। শীতের সকালের মিষ্টি রোদ আর সবুজ ঘাসের ডগায় এক ফোটা শিশির বিন্দু যেনো ঝলমলে বাংলার মাঠ ঘাট। তারপর কুকিলের ডাকে বসন্তের কথা বলে যায়। গাছের বাকল ফেটে বের হয় নতুন ঝলমলে পাতা, কত রকমের বাহারি ফুল, কৃষ্ণচুড়ার গাছ যেনো সেজে থাকে লাল ফুলের শাড়ীতে। বাংলার ছয় ঋতু তাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে রাখে সারা বছর প্রতিটি মাস প্রতিটি দিন।
আমাদের রূপসী বাংলা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মনোমুগ্ধকর। বাংলাদেশের সকল প্রান্তরে যেনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লুকায়িত রয়েছে। যে দিকেই দুচোখ যায় সব খানেই যেনো সুন্দর্যে ভরপুর আমাদের এই বাংলা। আমাদের এই রূপসী বাংলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতি বছর দেশ বিদেশ থেকে পর্যটক আসে ভ্রমণ করতে। বাংলার মানুষও দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে চলে। আমাদের দেশে অনেক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে যেসব জায়গায় প্রতিনিয়ত দেশ এবং দেশের বাহির থেকে অনেক মানুষ ঘুরতে আসে। আজকে এই প্রবন্ধে কিচছু উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি যা ভ্রমণ প্রিয় মানুষদের অনেক উপকারে আসবে।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের দক্ষিণে চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত। এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম ও বৃহত্তম অখন্ডিত সমুদ্র সৈকত। এই সমুদ্র সৈকতের একটি বৈশিষ্ট্য হলো সমস্ত সৈকত জুড়ে বালুকাময়, কাদার কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি, সোনালি বালুকোনা এবং দিগন্তজোড়া বিশাল সৈকত যেনো এক অনন্য দৃষ্টিনান্দন দৃশ্য। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এর অবিরাম ঢেউ আর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ভ্রমণ করতে আসে। এসব পর্যটন পয়েন্তের মধ্যে লাবণী পয়েন্ট, সুগন্ধা পয়েন্ট, ইনানী ও হিমছড়ি সব চেয়ে আকর্ষণীয়।
কক্সবাজার শুধু সমুদ্র সৈকতের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং এখানকার বিভিন্ন পর্যটন স্থান সমূহ দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। হিমছড়ির জলপ্রপাত, ইনানীর পাথুরে সৈকত, মহেশখালী দ্বীপ এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কক্সবাজার ভ্রমণের অংশ হিসেবে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমুদ্রের নির্মল বাতাস এবং আধুনিক পর্যটন সুবিধার কারণে কক্সবাজার বাংলাদেশের সেরা পর্যটন গন্তব্য। এটি শুধু দেশীয় পর্যটকদের জন্য নয়, বিদেশি পর্যটকদের কাছেও এক জনপ্রিয় ভ্রমণস্থল।
সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি ছোট প্রবাল দ্বীপ, যা কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। স্থানীয় ভাষায় এই দ্বীপকে “নারিকেল জিঞ্জিরা” বলা হয়, কারণ এখানে প্রচুর নারিকেল গাছ রয়েছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ হলো এর নীলচে-সবুজ স্বচ্ছ সমুদ্র, তুলতুলে সাদা বালুর সৈকত এবং প্রবাল প্রাচীর। দ্বীপের চারপাশে ছোট ছোট প্রবালখণ্ড ছড়িয়ে আছে, যা সমুদ্রের পানির নিচে এক অসাধারণ দৃশ্য তৈরি করে। এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার জন্য প্রচুর পর্যটক আসেন।
সেন্ট মার্টিনের মূল ভূখণ্ড থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত আর একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে যাকে ছেঁড়া দ্বীপ বলা হয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে এটি আরও বেশি নির্জন এবং সুন্দর। এসব দ্বীপের চারপাশে নানা রঙের প্রবাল, শামুক, ঝিনুক এবং সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। এই দ্বীপের প্রধান আকর্ষন হচ্ছে তাজা তাজা সামুদ্রিক মাছ এবং সুমিষ্ট নারিকেলের পানি।
সেন্ট মার্টিন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এখানে প্রতি বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভ্রমণপ্রেমিকরা ছুটে আছে। বাংলাদেশের বাহিরেও অনেক দেশ থেকে পর্যটক এখানের সৌন্দর্য উপভোক করতে আসে। তবে তবে অতিরিক্ত পর্যটন ও পরিবেশদূষণের কারণে দ্বীপের প্রবাল এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সেন্ট মার্টিন প্রকৃতির এক অনন্য উপহার, যা সবার জন্য একবার হলেও ঘুরে দেখার মতো জায়গা।
সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এবং এটি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিস্তৃত হলেও এর বৃহত্তর অংশ বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো থেকে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবন অসংখ্য নদী, খাল ও জঙ্গলে ঘেরা একটি বিস্ময়কর পরিবেশ তৈরি করেছে। এখানে গাছের মূল পানির ওপরে উঠে এসে এক রহস্যময় দৃশ্য তৈরি করে, যা ম্যানগ্রোভ বনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সুন্দরবলের মধ্যে অনেক পশুপাখি রয়েছে যেমন, কুমির, করিণ, বন্য শুকর, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদি সহ অসংখ্য পাখি। কিন্তু সুন্দরবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাণী হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনের অনেক নদীতে দেখা মিলে খুব দুর্লভ প্রজাতির ইরাবতী ডলফিনের।
সুন্দরবনের মধ্যে কটকা ও কোচিখালী নামক জায়গা রয়েছে যেখানে বাঘ ও হরিণসহ নানা বন্যপ্রাণী দেখার অন্যতম উপযুক্ত স্থান। এছাড়াও বন্যপ্রাণী দেখার জন্য একটি অনেক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে করমজল ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার। সুন্দরবনে প্রতি বছর দুবলার চর নামক স্থানে রাস পূর্ণিমার মেলা হয় যেখানে হাজার হাজার পর্যটক ও ভক্তদের আকর্ষণ করে।সুন্দরবন কেবল একটি বন নয়, এটি বাংলাদেশের এক অমূল্য সম্পদ যা পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে।
সিলেট বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এলাকা, যা মূলত চা বাগান, পাহাড়, নদী ও সবুজ প্রকৃতির জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে সিলেটের চা বাগান ও জাফলং ভ্রমণপিপাসুদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গা। সিলেটে প্রচুর চা বাগান রয়েছে যার ফলে সিলেটকে বাংলাদেশের চা শিল্পের রাজধানী বলা হয়। এখানকার মালনীছড়া, লাক্কাতুরা, শ্রীমঙ্গল, এবং জয়ন্তিয়া চা বাগানগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। মালনীছড়া চা বাগান বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহত্তম চা বাগান, যা ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিস্তৃত সবুজ চা বাগান, উঁচু-নিচু টিলা ও মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি এক স্বপ্নিল পরিবেশ সৃষ্টি করে। সিলেতের চা বাগানে ঘুরতে আসলে ভ্রমণপ্রেমীদের সবুজ মনোরম পরিবেশে চোখ জুড়িয়ে যাবে। তাই তো প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক সিলেটের চা বাগানের সবুজ প্রকৃতি দেখতে ছুটে আসে।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জাফলং অবস্থিত। এটি পিয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত, যা স্বচ্ছ পানির জন্য বিখ্যাত। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনাগুলো জাফলংকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পাথরের রাজ্য হিসেবে পরিচিত জাফলংয়ের স্বচ্ছ পানির নিচে থাকা বিভিন্ন আকারের পাথর পর্যটকদের মুগ্ধ করে। তবে জাফলংয়ের শীতল পানির ঝরনা ও পাহাড়ি পরিবেশ পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। এখানে আসলে খাসিয়া উপজাতিদের জীবনযাত্রা দেখার এক সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে।
সিলেটের চা বাগান ও জাফলং প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শান্ত পরিবেশ ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এই স্থানগুলোকে পর্যটকদের জন্য আদর্শ গন্তব্যে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত বান্দরবান ও রাঙামাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত দুটি পর্যটন স্থান। পাহাড়, ঝরনা, লেক ও আদিবাসী সংস্কৃতির সমৃদ্ধি এই স্থানগুলোকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বান্দরবান বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর পাহাড়ি জেলা, যা পর্যটকদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এটি চট্টগ্রাম বিভাগের একটি পার্বত্য জেলা, যেখানে দেশের সর্বোচ্চ পাহাড়শৃঙ্গগুলোর মধ্যে কেওক্রাডং (৩,১৭২ ফুট) এবং তাজিংডং (৩,১০০ ফুট) অবস্থিত। বান্দরবনের বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে তাদের মধ্যে নীলগিরি, বগা লেক, স্বর্ণমন্দির, আমিয়াখুম ও নাফাখুম জলপ্রপাত উন্নতম। নীলগিরি মেঘের রাজ্য হিসেবে পরিচিত যেখান থেকে পাহাড় ও মেঘের অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। স্বর্ণমন্দির বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ বৌদ্ধ মন্দির যা বান্দরবানের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে প্রকাশ করে।
রাঙামাটি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত জেলা। এটি কাপ্তাই হ্রদের জন্য বিখ্যাত, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম জলাধার। রাঙামাটির কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য ও নৌভ্রমণ পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। এখানে রয়েছে ঝুলন্ত সেতু যা রাঙামাটির প্রতীকী স্থাপনা, যা কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্মিত। আবার কাপ্তায় লেকের কাছে অবস্থিত সুবলং ঝরনা এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য স্থাপন করে। এখানকার রাজবাড়ি ও উপজাতীয় জাদুঘর আদিবাসী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেয়। সর্বপরী বলা যায়, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির অনন্য মিশ্রণে ভরপুর এই অঞ্চলগুলো প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য অসাধারণ ভ্রমণস্থান।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এটি নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলায় অবস্থিত এবং মহাবিহার বা সোমপুর মহাবিহার নামে পরিচিত। খ্রিস্টীয় ৮ম থেকে ৯ম শতকে পাল বংশের রাজা ধর্মপাল এই বিহারটি নির্মাণ করেন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বৌদ্ধ বিহার এবং ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের স্থাপত্যশৈলী অসাধারণ এবং এর মূল স্থাপনাটি একটি সুবিশাল চতুষ্কোণাকৃতির প্রাঙ্গণের মধ্যে অবস্থিত। বিহারের কেন্দ্রস্থলে ৭০ ফুট উচ্চতার একটি প্রধান স্তূপ রয়েছে, যা একসময় বিশাল আকারের ছিল। এই বিহারের চারপাশে ১৭৭টি ছোট ছোট কক্ষ রয়েছে, যা ভিক্ষুদের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এর দেওয়ালগুলো টেরাকোটার ফলকে সজ্জিত, যেখানে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, সমাজের নানা চিত্র এবং বৌদ্ধ ধর্মের নানা কাহিনি খোদাই করা হয়েছে।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারটি পাল আমলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এটি শুধু ধর্মীয় স্থানই নয়, বরং এটি শিক্ষারও একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল, যেখানে দেশ-বিদেশের ভিক্ষুরা ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন করতেন। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। সরকার ও ইউনেস্কোর উদ্যোগে এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এখানে একটি জাদুঘর রয়েছে, যেখানে বিহারের বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এটি বৌদ্ধ ধর্ম, শিক্ষা ও স্থাপত্যের সমৃদ্ধ অতীতকে তুলে ধরে, যা ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যা দেশের প্রাচীনতম শহর হিসেবে পরিচিত। এটি বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। মহাস্থানগড় একসময় মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন শাসকদের অধীনে ছিল এবং এটি একটি সমৃদ্ধ নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। এটি একটি বিশাল দুর্গনগর, যার চারপাশে উঁচু প্রাচীর রয়েছে। দুর্গের ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা, প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, জলাধার এবং শাসকদের বসবাসের স্থান রয়েছে। এখানে খননের মাধ্যমে আবিষ্কৃত শিলালিপি, মুদ্রা ও পোড়ামাটির ফলকগুলো এ অঞ্চলের সভ্যতার প্রাচীনত্বের প্রমাণ বহন করে।
মহাস্থানগড় হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলামী সভ্যতার নিদর্শন বহন করে। এখানে ‘মাহাস্থান ব্রাহ্মী শিলালিপি’ পাওয়া গেছে, যা খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীর লেখা বলে ধারণা করা হয়। বেহুলার বাসরঘর, গোবিন্দভিটা, খোদা পাঠিল, বৈরাগীর ভিটা ইত্যাদি স্থানগুলোর সঙ্গে নানা কিংবদন্তি ও ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িত। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই ঐতিহাসিক স্থানের সংরক্ষণে কাজ করছে। এখানে একটি জাদুঘর রয়েছে, যেখানে মহাস্থানগড় থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। মহাস্থানগড় বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসের এক উজ্জ্বল প্রতীক। এটি শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়, বরং অতীত সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্মারক, যা আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের পরিচায়ক।
কুয়াকাটা বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর সমুদ্র সৈকত, যা পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় অবস্থিত। এটি দেশের একমাত্র সৈকত, যেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করা যায়। এ কারণেই কুয়াকাটাকে ‘সাগরকন্যা’ বলা হয়। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ও প্রশস্ত এই সৈকত প্রকৃতির এক অসাধারণ দান। কুয়াকাটা কেবল সমুদ্র সৈকতই নয়, এটি বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থানসমৃদ্ধ একটি পর্যটন এলাকা। এখানে বালুকাবেলা, সবুজ কেয়া বন ও বিশাল সমুদ্রের ঢেউ পর্যটকদের মুগ্ধ করে। সৈকতের পাশে রয়েছে ফাতরার বন, যেখানে পর্যটকরা মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে পারেন। এছাড়া, রাখাইন সম্প্রদায়ের বসতি ও তাদের বৌদ্ধ মন্দিরও এখানে দেখার মতো স্থান।
কুয়াকাটা পর্যটকদের জন্য এক আদর্শ স্থান। এখানে সাঁতার কাটা, নৌকাভ্রমণ, ঘোড়ার গাড়ি ও মোটরবাইকে সৈকত ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। শীতকালে প্রচুর পরিযায়ী পাখি এখানে আসে, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। সরকার কুয়াকাটাকে একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে। নতুন অবকাঠামো নির্মাণ, হোটেল-রিসোর্ট বৃদ্ধি এবং পর্যটন সুবিধা উন্নত করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যে ভরপুর কুয়াকাটা বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। যারা প্রকৃতির শোভা ও সমুদ্রের বিশালতা উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য কুয়াকাটা একটি আদর্শ গন্তব্য।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন কেন্দ্রসমূহ দেশকে করেছে সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয়। পাহাড়, সমুদ্র, বন, নদী, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য এসবই বাংলাদেশের পর্যটনকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা, সুন্দরবন, সিলেটের চা বাগান, বান্দরবান ও রাঙামাটির পাহাড়ি সৌন্দর্য, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ও মহাস্থানগড়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সব মিলিয়ে দেশটি পর্যটকদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। তবে পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার এবং পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য টিকিয়ে রাখতে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও দায়িত্বশীল পর্যটন নিশ্চিত করাও প্রয়োজন।
আত্মবিশ্বাস বাড়ানো আমাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আত্মবিশ্বাস একজন মানুষের…
বাংলা সাহিত্যের প্রচলন অনেক আগে থেকেই। বাংলা সাহিত্যে অনেক কিছু শিক্ষণীয় বিষয়ের সাথে বাস্তবতার মিল…
স্বাস্থ্য মানুষের জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। অপরদিকে মানসিক প্রশান্তি ছাড়া আমাদের জীবনের সুখ শান্তি কল্পনা…
নাটক সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা। নাটকে আমরা মূলত অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের নড়াচড়া, কথাবার্তা ইত্যাদির মাধ্যমে…
সময় আমাদের জীবনের অনেক বড় একটি অংশ। এই পৃথিবীতে আমাদের সকলের জন্য নির্ধারিত সময় রয়েছে…
জাতীয় দিবস একটি নির্ধারিত দিন যে দিনে কোন রাষ্ট্র বা সার্বভৌম জাতির জাতিসত্তা চিহ্নিত করা…